বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বহুল আলোচিত ও কাঙ্ক্ষিত এমপিভুক্তির চূড়ান্ত তালিকার প্রজ্ঞাপন সহসা জারি হচ্ছে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারির সব আয়োজন চূড়ান্ত করলেও তালিকা চূড়ান্ত করা নিয়ে নতুন জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। মন্ত্রণালয যে তালিকা চূড়ান্ত করে অনুমোদনের জন্য শীর্ষ নীতিনির্ধারকপর্যায়ে পাঠিয়েছে, সে তালিকা দফায় দফায় ফেরত আসছে এবং সংশোধন হচ্ছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগে (মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগ) শীর্ষপর্যায়ের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো নয়া দিগন্তকে জানান, এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের তালিকা এখনো ঘষামাজা চলছে। তালিকায় কতগুলো স্কুল, কলেজ, মাদরাসা এবং কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থান পাবে তা নিয়ে টানাপড়েন চলছে। তবে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সাথে প্রতিনিয়ত এ বিষয়ে সমন্বয় করা হচ্ছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, জনবল কাঠামো এবং এমপিও নীতিমালার শর্তেই এমপিওভুক্ত করা হবে বেসরকারি নতুন শিাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে। প্রাথমিকভাবে কিছু শর্ত সাপেে আগামী তিন বছরের জন্য অস্থায়ীভাবে এক হাজার ৭৬৩টি স্কুল ও কলেজ এ তালিকায় স্থান পেতে পারে। মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে। এর সংখ্যা এখনো নিশ্চিত করা হয়নি। অস্থায়ী অনুমোদন বা তালিকায় স্থান পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেয়া শর্ত যথাযথভাবে পূরণে ব্যর্থ হলে প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির সুবিধা বাতিল করা হবে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানান, এবার শিাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ধরন অনুসারে আলাদা আলাদা পরিপত্র জারি করা হবে। নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিা প্রতিষ্ঠানের আলাদা আলাদা পরিপত্র জারি হতে পারে। একই পরিপত্রে সব প্রতিষ্ঠানে অনুমোদন দেয়া হলে নানা জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা করছে মন্ত্রণালয়। জটিলতা এড়াতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে।
গত ১৪ আগস্ট শর্ত পূরণ করা প্রায় দুই হাজার ৭০০ স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছিল বলে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এবং এমপিওর জন্য প্রতিষ্ঠান যাচাই-বাছাই কমিটির আহ্বায়ক জাবেদ আহমেদ জানিয়েছিলেন সাংবাদিকদের। কিন্ত সে তালিকা দফায় দফায় ফেরত আসছে এবং বার বার সংশোধন-সংযোজন হচ্ছে।
শিা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো: সোহরাব হোসাইন জানান, প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পরই শিামন্ত্রণালয় থেকে প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। প্রজ্ঞাপন যে দিনই জারি হোক, তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা গত ১ জুলাই’ ১৯ থেকেই এমপিওর সুবিধা পাবেন।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় রেখেই নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার ক্ষেত্রে ২০১৮ সালে জারি করা নীতিমালাকে প্রাধান্য দিয়ে তালিকা চ‚ড়ান্ত করা হয়েছে। নীতিমালার কঠোর শর্ত কিঞ্চিৎ শিথিল করে হাওর, চরাঞ্চল, পাহাড়ি এলাকা, অনগ্রসর এলাকার কিছু প্রতিষ্ঠানকে এমপিওর আওতায় আনা এবং বাদ পড়া উপজেলায় অন্তত একটি করে হলেও প্রতিষ্ঠান এমপিওর তালিকায় স্থান দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো তালিকায়। সারা দেশের ৮৯টি উপজেলার একটি শিাপ্রতিষ্ঠানও এমপিওভুক্তির যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। সমতার স্বার্থে ওইসব উপজেলায় শর্ত শিথিল করে শিায় অনগ্রসর, ভৌগোলিকভাবে অসুবিধাজনক, পাহাড়ি, হাওর-বাঁওড়, চরাঞ্চল, নারী শিা, সামাজিকভাবে অনগ্রসর গোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী, বিশেষায়িত শিাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার েেত্র বিশেষ বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। নীতিমালা ও যোগ্যতার শর্ত পূরণ করতে না পারাদের এমপিওর আওতায় আনতে শর্ত কিছুটা শিথিল করা হয়েছে। তবে তা যোগ্যতার ন্যূনতম ৫০ নাম্বার প্রাপ্তি সাপেক্ষে।
বর্তমানে সারা দেশে এমপিওভুক্ত শিাপ্রতিষ্ঠান ২৬ হাজারের বেশি। এগুলোতে কর্মরত প্রায় পাঁচ লাখ শিক-কর্মচারীকে প্রতি মাসে বেতন ও কিছু ভাতা সরকার দিয়ে থাকে। এমপিওভুক্তি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি কর্মসূচি। এখনো শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা বোর্ডের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজারের মতো। এখানে কর্মরত রয়েছেন, ৮০ হাজারের মতো শিক্ষক-কর্মচারী। গত বছর (জুলাই ২০১৮) জারি করা এমপিও নীতিমালা অনুসারে এখন এমপিওর জন্য যোগ্যপ্রতিষ্ঠান বাছাই করা হয়েছে দুই হাজার ৭৬২টি। এর মধ্যে বিদ্যালয় ও কলেজ ১ হাজার ৬২৯টি এবং মাদরাসা ৫৫১টি ও কারিগরি প্রতিষ্ঠান ৫৮২টি।
২০১৮ সালে জারি করা জনবল কাঠামো এবং এমপিও নীতিমালার শর্ত পূরণ করা বা যোগ্য হিসেবে ২ হাজার ৭৬২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বাছাই করেছে মন্ত্রণালয়ের যাচাই-বাছাই কমিটি। এর মধ্যে স্কুল ও কলেজ ১ হাজার ৬২৯টি এবং মাদরাসা ৫৫১টি ও কারিগরি প্রতিষ্ঠান ৫৮২টি। এমপিওভুক্তির জন্য ৬ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবেদন করেছিল।
মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এবার শর্তসাপেে এমপিওভুক্তি দেয়া হতে পারে। এখন থেকে প্রতি বছর এমপিওভুক্ত শিাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মিত পর্যালোচনায় মধ্যে রাখা হবে। শর্তাবলির অন্যতম হলো, এমপিওভুক্ত হওয়া শিাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিটিকে পাবলিক পরীায় মোট শিার্থীর কমপে ৭০ শতাংশ পাস করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে ওই বছরই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি স্থগিত হয়ে যাবে। তবে ভবিষ্যতে ভালো ফল করতে পারলে ফের তা চালু হবে। পরিপত্রে এ সব শর্ত ছাড়াও আরো কিছু শর্ত জুড়ে দেয়া হতে পারে। এর অন্যতম হচ্ছে- প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কমপে একটি কাসরুমকে মাল্টিমিডিয়া কাসরুম হিসেবে তৈরি করতে হবে। শিাপ্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানাগার ভালো মানের হতে হবে।
জানা গেছে, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে এমপিওভুক্তির জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৮৬৫ কোটি টাকা। এক হাজার ৭৬৩টি শিাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হলে তাতে ব্যয় হবে ৭৯৬ কোটি ৪৬ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। বাকি ৬৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকা মন্ত্রণালয়ের হাতে উদ্বৃত্ত থাকবে। বুয়েটের তৈরি করে দেয়া বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে এবার শিাপ্রতিষ্ঠান বাছাই করা হয়েছে। এমপিওভুক্তির নীতিমালা-২০১৮ অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় সব শর্ত পূরণ করেছে।
সারা দেশে এমপিওভুক্তির জন্য চূড়ান্ত করা শিাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৫৫১টি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়, এক হাজার দুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৬৭টি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ৯৪টি উচ্চমাধ্যমিক কলেজ এবং ৫৩টি ডিগ্রি (অনার্স-মাস্টার্স) পর্যায়ের কলেজ রয়েছে। এর বাইরে রয়েছে মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এমপিওভুক্তির জন্য শিামন্ত্রণালয়ে আবেদন জমা পড়েছিল ৬ হাজার ১৪১টি।
৫৫১টি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত করতে এক বছরে ব্যয় হবে ১৯১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। একইভাবে এক হাজার দুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য ৪৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ৬৭টি স্কুল অ্যান্ড কলেজের জন্য ৪২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, ৯৪টি উচ্চমাধ্যমিক কলেজের জন্য ৮৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা এবং ৫৩টি ডিগ্রি (অনার্স-মাস্টার্স) পর্যায়ের কলেজের এমপিওভুক্তিতে ২৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। মোট ব্যয় হবে ৭৯৬ কোটি ৮৬ লাখ ৪৩ হাজার টাকা।
স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সব কয়টি প্রতিষ্ঠানকেই এমপিওর আওতায় নেয়ার দাবি জানিয়ে গত কয়েক বছর ধরে আন্দোলনরত সংগঠন নন-এমপিওভুক্ত শিাপ্রতিষ্ঠান শিক-কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যক্ষ মাহমুদুন্নবী ডলার নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের বিশ্বাস সরকার দাবি মেনে নেবে। নির্বাচনের আগে দেয়া প্রতিশ্রæতি বাস্তবায়ন করবে। তিনি বলেন, এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ১৭-১৮ বছর ধরে বিনা বেতনে এই পেশায় আছেন। অনেকের বয়স শেষের দিকে। মানবিক বিবেচনায় নীতিমালার শর্ত শিথিল করে হলেও এ সব শিক্ষককে বিবেচনায় নেবেন প্রধানমন্ত্রী; অন্যথায় তারা ভয়ানক ক্ষতির মুখে পড়বেন।
Leave a Reply